নবম থেকে পঞ্চদশ শতক খ্রিষ্টানদের মধ্যযুগের শেষ পর্যায়। স্পেনের গ্রানাডার মুসলিম রাষ্ট্র তীব্র গতিতে ছুটছিল ধ্বংসের দিকে। রাজা পঞ্চম ফার্ডিনান্ডের সাথে পর্তুগিজ রানী ইসাবেলার বিয়ের মাধ্যমে গড়ে ওঠা খ্রিষ্টান শক্তির ঐক্য স্পেনে মিটমিট করে জ্বলতে থাকা মুসলমানদের প্রদীপে বাতাসের প্রবল ঝাপটা দিলো। ফার্ডিনান্ডের শক্তির সামনে ছোট ছোট খ্রিষ্টান শাসকরা ছিল সাধারণ সর্দারের মত। মুসলমানদের ধর্মচ্যুত করার কঠোর প্রয়াস চলে ফার্ডিনান্ডের আমলে। মুসলমানদের আরবি পড়া নিষিদ্ধ হয়। আরবীয় পোশাক বেআইনি করা হয়। বাধ্য করা হয় মুসলমানদের খ্রিষ্টান স্কুলে ভর্তি হতে। যারা খ্রিষ্ট ধর্ম গ্রহণ করত, তাদের জন্য ছিল বিভিন্ন সুযোগ। মুসলমানদের জন্য বিশেষ পোশাকের ব্যবস্থা ছিল। হাটেঘাটে অপদস্থ করা হতো তাদের।
পয়লা এপ্রিল। ১৪৯২ খ্রিষ্টাব্দ মোতাবেক ৮৯৭ হিজরির ১২ রবিউল আউয়াল। নিভে গেল মিটমিট করে জ্বলতে থাকা মুসলিম রাষ্ট্রশক্তির প্রদীপের শেষ আলো। অনেক আগেই রাজা ফার্ডিনান্ড ও রানী ইসাবেলা মুসলমানদের হাত থেকে কর্ডোভাসহ অনেক অঞ্চল দখল করে নিয়েছিলেন। বাকি ছিল গ্রানাডা। এর শাসনকর্তা ছিলেন আবুল হাসান। কিন্তু পুত্র আবু আব্দুল্লাহর বিশ¡াসঘাতকতার জন্য হারান শাসন ক্ষমতা। মসনদে বসেন আবু আব্দুল্লাহ। কিন্তু বেশি দিন স্থায়ী হয়নি তার এ মসনদ। অবশেষে নিজের জীবন বাঁচাতে ফার্ডিনান্ডের সাথে সন্ধি করেন। বীর সেনাপতি মুসা রাজা ফার্ডিনান্ডের কাছে আত্মসমর্পণের চেয়ে সম্মুখ সমরে যুদ্ধ করে প্রাণ বিসর্জন দেয়াকেই অধিক সম্মানজনক মনে করে ছিলেন। আবু আব্দুল্লাহ খ্রিষ্টানদের কাছে আত্মসমর্পণ করে প্রাণে রক্ষা পাবেন বলে যে ধারণা করেছিলেন, শিগগিরই তা মিথ্যায় পর্যবসিত হয়। প্রতিশ্রুতি ভঙ্গ করে ফার্ডিনান্ড বাহিনী শহর অবরোধ করে রাখে। বিচ্ছিন্নভাবে যুদ্ধ চালিয়ে যান কিছু মুসলমান। এ সময় রাজা ফার্ডিনান্ডের একটি ঘোষণাপত্র প্রচার করা হয়¬ ‘যেসব মুসলমান নিরস্ত্র হয়ে গ্রানাডার মসজিদগুলোতে আশ্রয় নেবে তাদের পূর্ণ নিরাপত্তা দেয়া হবে। আর যারা খ্রিষ্টান জাহাজগুলোতে আশ্রয় নেবে, তাদের অন্যান্য মুসলিম রাষ্ট্রে পাঠিয়ে দেয়া হবে। অন্যথায় আমাদের হাতে তোমাদের প্রাণ হারাতে হবে।’ অসহায় মুসলমানরা সরল বিশ¡াসে বন্ধ করে দেয় যুদ্ধ। অনেকে আরোহণ করেন জাহাজে, অনেকে আশ্রয় নেন মসজিদে। কিন্তু প্রতারক ফার্ডিনেন্ড মসজিদে আশ্রয় গ্রহণকারী নিরস্ত্র মুসলিম শিশু-বৃদ্ধ, নর-নারীকে পুড়িয়ে এবং জাহাজে আরোহণকারী মুসলমানদের জাহাজ ডুবিয়ে হত্যা করে। এ হৃদয়বিদারক ও করুণ ঘটনা যেদিন ঘটেছিল সে দিন ছিল পয়লা এপ্রিল।
বর্তমানে চালু আছে ‘এপ্রিল ফুল ডে’র নানা রকম ইতিহাস ও গল্প। এপ্রিল ফুল বাংলাদেশের বা প্রাচ্যের কোনো উৎসব বা আনন্দের দিন নয়। বাংলাদেশসহ এই উপমহাদেশে দিনটির প্রচলন হয় ১৭৫৭ সালে পলাশীর আম্রকাননে ইংরেজদের সাথে যুদ্ধে নবাব সিরাজউদ্দৌলার পরাজয়ের পরিণামে। ব্রিটিশরা আমাদের প্রায় ২০০ বছর শাসন করেছিল। অন্য অনেক কিছুর মতো ইংরেজরা এ দেশে তাদের শিক্ষা ও সংস্কৃতির নানা বিষয় চালু করে। এর একটি দৃষ্টান্ত, এপ্রিলের ১ তারিখে ‘এপ্রিল ফুল ডে’ চালু করা।
এপ্রিল ফুল ডে উদযাপনের জন্য একে অন্যকে বোকা বানায়। কেউ কেউ বলে থাকেন, বিভিন্ন দেশে একই সময়ে এপ্রিল ফুল ডে’র সূচনা হয় বিশেষ করে বসন্ত বিদায়ের উৎসবকে সামনে রেখে। ইংল্যান্ডে আঠারো শতক থেকে দিনটি ব্যাপকভাবে উদযাপিত হতে থাকে। ইংরেজ ও ফরাসিরা তাদের উপনিবেশগুলোতে এ প্রথার প্রচলন করে। স্কটল্যান্ডে ৪৮ ঘন্টাব্যাপী এপ্রিল ফুল ডে উদযাপিত হয়। মেক্সিকোতে এ দিবসটি অন্য প্রেক্ষাপটে উদযাপিত হয়ে থাকে। ডিসেম্বরের ২৮ তারিখ খ্রিষ্টানরা এরাডসের হাতে নিষ্পাপ শিশুদের নির্মম হত্যাকাণ্ডের স্মরণে দিনটি উদযাপন করে। ভিন্ন ইতিহাসে ১৫৬৪ সালে ফ্রান্সে প্রবর্তিত নতুন ক্যালেন্ডারকে সামনে রেখে আধুনিক এপ্রিল ফুল ডে উদযাপিত হয়। তার আগে ইউরোপে একটিমাত্র ক্যালেন্ডার ব্যবহৃত হতো। তখন বছরের সূচনা হতো এপ্রিল মাসের ১ তারিখ থেকে। ১৫৬৪ সালে ফ্রান্সের সম্রাট দশম চার্লস এই পুরনো তারিখ পরিবর্তন করেন। তিনি ১ জানুয়ারি থেকে নববর্ষ চালুর ঘোষণা দেন। এটা পৃথিবীর সর্বত্র আজো চালু আছে। ঊনবিংশ শতাব্দীর খ্রিষ্টানদের বিখ্যাত বিশ¡কোষে উল্লেখিত ইহুদি ও খ্রিষ্টানদের বর্ণনায় পয়লা এপ্রিল হলো সেই তারিখ, যাতে পারস্যবাসী ও ইহুদিদের পক্ষ থেকে হজরত ঈসা (আঃ) কে ঠাট্টা-বিদ্রুপের টার্গেট বানানো হয়েছিল। ইঞ্জিলের মধ্যে (বর্তমানে যা বাইবেল) ঘটনার বিবরণ এরূপ্ল ‘আর সে ব্যক্তি ঈসা (আঃ) কে বন্দী করে তার সাথে ঠাট্টা-পরিহাস করত এবং তাকে আঘাত করত, আর চোখ বেঁধে তার গালে চড়-থাপ্পর মারত এবং তাকে এই বলে জিজ্ঞাসা করা হতো, নবুয়তের মাধ্যমে বলো কে তোমাকে মারছে? এভাবে ভর্ৎসনা করে আরো অনেক কথা তার বিরুদ্ধে বলা হয়।’ (লুক, ২২ঃ৬৩-৬৫)। হজরত ঈসা (আঃ) কে বিচারের নামে পিলাতস থেকে হিরোডস আবার হিরোডস থেকে পিলাতসের আদালতে প্রেরণ করার উদ্দেশ্য হলো ঠাট্টা পরিহাস করে তাকে কষ্ট দেয়া। আর এ ঘটনা যেহেতু পয়লা এপ্রিলে সংঘটিত হয়েছিল। সে জন্য এপ্রিল ফুল ডে বাস্তবিকভাবেই একটি লজ্জাজনক ঘটনার স্মৃতি।
কাউকে ধোঁকা দেয়া এবং বোকা বানানো সম্পর্কে ইসলামে রয়েছে কঠোর নিষেধাজ্ঞা। রাসূল সাঃ বলেছেন, ‘ যে ব্যক্তি অন্যকে ধোঁকা দেয়, সে আমার উম্মতের অন্তর্ভুক্ত নয়।’ (মুসলিম, মিশকাত ঃ ২৪৮) ‘অভিশপ্ত ওই ব্যক্তি যে কোনো মুমিন ব্যক্তির ক্ষতি সাধন করে কিংবা তাকে ধোঁকা দেয়।’ (তিরমিজি, মিশকাত ঃ ৪২৮) নবী করিম সাঃ অন্যত্র বলেছেন¬ ‘ যে ব্যক্তি যে জাতির অনুসরণ-অনুকরণ করবে, তার হাশর হবে ওই জাতির সাথে।’ তিনি আরো বলেছেন¬ ‘মুসলিম তো সে-ই, যে কাউকে প্রতারিত করে না, নিজেও প্রতারিত হয় না।’ ইতিহাস পর্যালোচনা করলে প্রতীয়মাণ হয় যে, তারা মুসলমানদিগের শুধু অত্যাচার নির্যাতন কঙ্কালসার এবং কাঙ্গালেই পরিণত করেনি বরং তারা কৌশলে আমাদের জাতীয় ইতিহাস ঐতিহ্যেও আঘাত হানছে দিনের পর দিন। সে কথাও কারো অজানা নয়।
এপ্রিল ফুল উৎসব আজ মুসলমানদের জাতীয় জীবনেও প্রবেশ করেছে। অথচ এর উৎস মূলত মুসলমানদের বিরুদ্ধে স্পেনের মাটিতে খ্রিষ্টানদের প্রতারণাপূর্ণ বিজয়ের ইতিহাস। কেননা, পয়লা এপ্রিলের অন্য সব ইতিহাস ১৪৯২ সালের পরে। আর ঈসা (আঃ) সম্পর্কিত ঘটনার ভিত্তি খুবই দুর্বল। ১৯৯২ সালে পশ্চিমা বিশে¡ স্পেন থেকে মুসলিম উৎখাতের ৫০০তম বার্ষিকী (১৪৯২-১৯৯২) মহা ধুমধামের সাথে উদযাপন করা হয়। ইতিহাসের হৃদয়বিদারক ঘটনা ভুলে না গেলে এপ্রিল ফুল কোনো মুসলমানকে আনন্দ দান করতে পারে না। এখন আমরা কি পয়লা এপ্রিল হাসি-আনন্দের সাথে ‘এপ্রিল ফুল ডে’ উদযাপন করবো, নাকি ইউরোপের বুকে অসহায় মুসলিম নারী-পুরুষ, শিশুদের নৃশংস হত্যাকাণ্ডের স্মরণে দুঃখ অনুভব করব।
যুগে যুগে এপ্রিল ফুল পালনের ইতিকথা
অনেক আগে থেকেই পহেলা এপ্রিল বিভিন্ন দেশে বিভিন্নভাবে উদযাপিত হত। তবে কিভাবে যে এপ্রিল ফুলের সূচনা হয় তা নিয়ে ইতিহাসবিদদের মধ্যে বিস্তর মতভেদ রয়েছে। প্রাচীনকালে জনপ্রিয় উৎসবসমূহ পালিত হত বসন্তকালীন বিষুব সময়ে (Vernal Equinox), অর্থাৎ যে সময়ে দিনরাত মোটামুটি সমান থাকে। সময়টি হল ২১ মার্চ থেকে ২৩ সেপেম্বর পর্যন্ত। ঋতু পরিবর্তনের প্রান্তিক সময় ২৫ মার্চ থেকে ২ এপ্রিল (অর্থাৎ শীতের শেষে বা বসন্তের শুরুতে) পুরাতন জুলিয়ীও (Julian) ক্যালেন্ডার অনুযায়ী গোটা ইউরোপে সপ্তাহব্যাপী উৎসব উদ্দীপনা চলত। এর বাইরে মধ্যযুগে মার্চের ২৫ তারিখে মহাসমারোহে নবান্ন উৎসব পালিত হত সারা ইউরোপ জুড়েও। রোমানদের মত হিন্দুরাও নতুন বছরের শুরু এপ্রিলের ১ অথবা এর আশেপাশে একদিন পঞ্জিকানুযায়ী পালন করত। আঠার শতকে এপ্রিল ফুল বর্তমান অবয়ব ধারণ করার আগ পর্যন্ত গ্রেট বৃটেনে সাধারণ মানুষদের ঐতিহ্যবাহী মেলা বসত প্রতি বছরের পহেলা এপ্রিলে । স্কটল্যান্ডে এই দিনটিকে বলা হত ‘ কোকিল শিকারের দিন (hunting the day of cuckoo)’। এপ্রিল ফুল নতুন রুপে জন্মলাভের পর এর নামকরণ করা হয় এপ্রিল-কোকিল (April-cuckoo)। পূরো কাহিনীর সাথে এই দিনের যোগসূত্র স্থাপন করতে গিয়ে ১৪০০ খ্রিষ্টাব্দের চোসার (Chaucer)-এর The Nuns Priests Tale গল্পের দুই বোকার ৩২ দিনের কাহিনী (Thirty days and two) চলে আসে। আর ৩২ দিনের শুরুটি হল মার্চের ১ তারিখ, অর্থাৎ শেষ দিনটি কিনা ১ এপ্রিল।
ইউরোপে সম্ভবত এপ্রিল ফুলের বিস্তৃতি ঘটে প্রথমে ফ্রেঞ্চ জাতির মধ্যে। ফ্রেঞ্চরা ১৫০৮ সাল এবং ডাচরা ১৫৩৯ সাল থেকে এপ্রিল মাসের প্রথম দিনকে কৌতুকের দিন বা বছরের সবচেয়ে হালকা দিন হিসেবে পালন করা শুরু করে। ফ্রান্সই হলো প্রথম দেশ যেদেশে সরকারীভাবে নবম চার্লস (Charles IX) ১৫৬৪ সালে এক ফরমানের মাধ্যমে ১ জানুয়ারীকে নববর্ষ হিসেবে ঘোষণা করেছিলেন।
অর্থাৎ তিনি এটি করেন ১৫৮২ সালে ইতালিয়ান পোপ ত্রয়োদশ গ্রেগরী (Pope Gregory XII) প্রবর্তিত গ্রেগরীয়ান ক্যালেন্ডার (যেটিকে আমরা বর্তমানে ভুল করে ইংলিশ ক্যালেন্ডার বলি) হিসেবে প্রচলন হওয়ারও আগে। এরই সাথে ১ এপ্রিলে বন্ধু-বান্ধবদের উপহার দেয়া-নেয়ার প্রথাটি বদল হয়ে চলে যায় ১ জানুয়ারী বা নিউ ইয়ার উদযাপনের প্রাক্কালে। কারণ তখন পর্যন্ত বিভিন্ন দেশে জুলিয়ীও ক্যালেন্ডার অনুযায়ী নিউইয়ার পালিত হত ১ এপ্রিলে। অনেকেই এই পরিবর্তনকে মেনে নিতে না পেরে এদিনই অর্থাৎ ১ এপ্রিলেই তাদের পুরোনো প্রথাসমূহ চালিয়ে যেতে থাকে। কিন্তু বিপরীতে ১ জানুয়ারীর পক্ষের লোকজন এদেরকে ফাকি দিতে ১ এপ্রিলে ভূয়া উপহার পাঠানোর কালচারটি চালু করে দেয়। ফ্রান্সে কাউকে বোকা বানালে বলা হত এপ্রিল মাছ (April fish), ফ্রেঞ্চ ভাষায় poisson davril । এরকম অদ্ভূত নামকরনের ব্যাখায় বলা হয়, রাশিচক্র অনুযায়ী স¡র্গের কালিকরেখা অতিক্রম করাকালে এপ্রিলে সূর্যকে মাছের মত দেখায়। এইদিনে তারা ছুটি কাটাত এবং মরা মাছ এনে তাদের বন্ধুদের পেছনে সেটে দিয়ে মজা করত। এখন মরা মাছের বদলে ছোটরা আসল মাছের স্টিকি কাগজ বন্ধুদের শার্টের পেছনে গেঁথে দেয়। ক্যান্ডিশপ ও বেকারীগুলোও মাছ আকৃতির মিষ্টি পরিবেশন করে এইদিন স্মরণ করে।
ডাচদের পহেলা এপ্রিল পালন করার আরো কিছু কারণ আছে। স্পেনের রাজা দ্বিতীয় ফিলিপ (King Philip II) ১৫৭২ সালে নেদারল্যান্ড শাসন করতেন। যারা তার শাসন অমান্য করেছিল তারা নিজেদেরকে গুইযেন (যার অর্থ ভিখারী) বলে পরিচয় দিত । ১৫৭২ সালের এপ্রিলের ১ তারিখে গুইযেন বা বিদ্রোহীরা উপকূলীয় ছোট শহর ডেন ব্রিয়েল (Den Briel) করায়ত্ব করে ফেলে। তাদের এই সফলতায় বিদ্রোহের দাবানল দেশব্যাপী ছড়িয়ে পড়ে। শেষমেশ স্প্যানিশ সেনাপ্রধান বা দ্য ডিউক অব অ্যালবা (the Duke of Alba) প্রতিরোধ করতে ব্যর্থ হন। ‘ব্রিয়েল’ হল ডাচ শব্দ, যার অর্থ কাঁচ। ১৯৭২ সালের ১ এপ্রিল স্মরণে ডাচরা বিদ্রুপ করে স্প্যানিশদের ‘অ্যালবা কাঁচ হারিয়েছে (Alba lost glasses)’ বলে পূরোনো স্মৃতি রোমন্থন করে থাকে। উল্লেখ্য, অ্যালবা হল স্পেনের শহরের নাম যেখানে দ্য ডিউক অব অ্যালবার সদর দপ্তর ছিল।
এপ্রিল ফুলের আরেকটি ব্যাখ্যা দিয়েছেন বোস্টন বিশ¡বিদ্যালয়ের ইতিহাসের প্রফেসর জোসেফ বসকিন (Joseph Boskin)। তিনি বলেছেন এই প্রথাটির শুরু হয় রোমান সম্রাট কনস্ট্যান্টাইনের (২৮৮-৩৩৭ খ্রীঃ) শাসনামলে। হাসি-ঠাট্টা নিয়ে মেতে থাকে এমন একদল বোকা গোপাল ভাঁড়েরা সম্রাটকে কৌতুক করে বলে, তারা রাজার চেয়ে ভালভাবে দেশ চালাতে পারবে। রাজা মহোদয় বেশ পুলকিত হলেন। রাজা গোপাল ভাড়দের সর্দার কুগেল (Kugel) কে একদিনের জন্য বাদশাহ বানিয়ে ক্ষমতা ছেড়ে দিলেন। আর কুগেল সুযোগটাকে কাজে লাগিয়ে রাজ্যময় আইন জারি করে দিল, প্রতিবছরের এইদিনে সবাই মিলে তামাশা করবে। প্রফেসর বসকিন আরো বলেন, প্রাচীন ওই সময়ের মারাত্মক দিনগুলোতে রাজাদের দরবারে কিন্তু বোকারুপিরাই ছিল প্রকৃত জ্ঞানী। তারা মজা বা হাসি-ঠাট্টার মাধ্যমে অনেক কাজ কৌশলে হাসিল করে নিত বা জ্ঞানের কথা রসালোভাবে চারদিকে ছড়িয়ে দিত।
১৯৮৩ সালে বার্তা সংস্থা এপি পরিবেশিত বসকিনের এই ব্যাখ্যাটি অনেক কাগজে নিবন্ধাকারে প্রকাশিত হয়। বসকিন মূলত- আগের সব ব্যাখ্যাকে উড়িয়ে দিয়েছেন। আর্টিকেলটি ছাপানোর আগে এপি দুই সপ্তাহ ধরে ভেবেছে তারা নিজেরাই এপ্রিল ফুল বোকামীর শিকার হচ্ছে না তো! পাশ্চাত্যের বিভিন্ন সংস্কৃতিতে কাউকে বিভিন্নভাবে বোকা বানানোর প্রথা চালু রয়েছে। রোমানদের হিলারিয়া (Hilaria) উৎসব এর মধ্যে অন্যতম। তারা মার্চের ২৫ তারিখে আট্টিসের পূনরুত্থান নিয়ে এইদিনে হালকামি করত, ইহুদীরা করত পুরিম (Purim) উপলক্ষ্যে। হিন্দুরাও হোলি উৎসব এইদিনের আশেপাশে করে থাকে। ইসলামে মিথ্যা কথা বলে ঠকানো কঠোরভাবে নিষিদ্ধ। যেমন, নবী (সঃ) বলেছেন, “যারা ধোঁকাবাজি করে তারা আমাদের দলভুক্ত নয়।” তবে ইসলামে সত্য কথা বলেও হাস্যরস করা বা বিভিন্ন রকমের জ্ঞানোদ্দীপক কৌতুকের প্রচলন রয়েছে। মুহম্মদ (সাঃ) এবং তার সংগীসহ ইসলামী ব্যক্তিত্বের অনেকের জীবনীতেই প্রচুর রসালো গল্পের উদাহরণ ইতিহাসে পাওয়া যায়।
অন্যান্য দিবসের মত এই দিবসটিরও উৎপত্তি পাশ্চাত্যে শুরু হলেও এর বিস্তৃতি এখন দেশে দেশে। শুধুমাত্র বাংলাদেশে (বৃহৎ অর্থে, উপমহাদেশে) কিছু মুসলমানদের মধ্যে এপ্রিল ফুলের ব্যাখ্যায় নতুন মাত্রা লাভ করেছে। তা হলো, গ্রানাডার বেদনাদায়ক ঘটনার সংযোজন। সুদীর্ঘ আটশো বছরের ইসলামের গৌরবময় শাসন শেষে স্পেন মুসলমানদের হাতছাড়া হয় ১৪৯২ সালে। বলা হয়, পরাজিত হাজার হাজার মুসলমান নারী, পুরুষ, শিশুদেরকে মসজিদের মধ্যে কৌশলে ঢুকিয়ে রাজা ফার্দিনান্দ ও পর্তুগিজ রানী ইসাবেলার নির্দেশে পুড়িয়ে মেরে জঘন্যতম এই কাণ্ডটি করা হয় ইতিহাসের এই দিনে। ইতিহাসবিদরাই ভাল বলতে পারবেন কোনটি সঠিক। গ্রানাডার সর্বশেষ মূরিশ কিং হলেন নাসরিদ বংশীয় আবু আব্দুল্লাহ মোহাম্মদ (Abu Abdullah Muhammad XII), যাকে স্প্যানিশরা ‘ বোয়াবদিল’ নাম দিয়েছে। বিলাস-ব্যসনে মত্ত ও উচ্ছন্নে যাওয়া আবু আব্দুল্লাহ হলেন গ্রানাডার তাইফার সুলতান আবুল হাসানের ছেলে। ছেলের ষড়যন্ত্র ও কুচক্রের কারণেই অনেকটা সিরাজউদ্দৌলার মতই বাবা আবুল হাসান পালিয়ে যেতে বাধ্য হন। মীরজাফরের মত আবু আব্দুল্লাহকে বানানো হয় নামকাওয়াস্তে সুলতান। এই পুতুল সুলতানের কাছেও ১৪৮৯ সালে ফার্দিনান্দ ও ইসাবেলার নিকট থেকে চুড়ান্তরুপে নিঃশর্তভাবে আত্মসমর্পনের নির্দেশনা আসে এবং স্মরণ করিয়ে দেয়া হয় অস¡ীকারের ভয়াবহ পরিনতির কথাও। সে সময়ে এপ্রিল ফুলের ঘটনার মত কোন ঘটনা ঘটেছে কিনা ইঊরোপীয় ঐতিহাসিকরা তা উল্লেখ করেননি।
আত্মসমর্পন ঘটনার তিনমাস পরে স্পেনের বিপর্যস্ত মুসলমানদেরকে মসজিদের মধ্যে ঢুকিয়ে পুড়িয়ে মারা হয়েছে, নাকি ইতিহাসের অলীক মারপ্যাচে বাংলাদেশের মুসলমানদেরকেই এপ্রিল ফুলের বোকা বানানো হয়েছে তা নির্নয়ের দায়িত্ব ইতিহাসবেত্তাদের নিকটই ছেড়ে দিলাম।
পয়লা এপ্রিল। ১৪৯২ খ্রিষ্টাব্দ মোতাবেক ৮৯৭ হিজরির ১২ রবিউল আউয়াল। নিভে গেল মিটমিট করে জ্বলতে থাকা মুসলিম রাষ্ট্রশক্তির প্রদীপের শেষ আলো। অনেক আগেই রাজা ফার্ডিনান্ড ও রানী ইসাবেলা মুসলমানদের হাত থেকে কর্ডোভাসহ অনেক অঞ্চল দখল করে নিয়েছিলেন। বাকি ছিল গ্রানাডা। এর শাসনকর্তা ছিলেন আবুল হাসান। কিন্তু পুত্র আবু আব্দুল্লাহর বিশ¡াসঘাতকতার জন্য হারান শাসন ক্ষমতা। মসনদে বসেন আবু আব্দুল্লাহ। কিন্তু বেশি দিন স্থায়ী হয়নি তার এ মসনদ। অবশেষে নিজের জীবন বাঁচাতে ফার্ডিনান্ডের সাথে সন্ধি করেন। বীর সেনাপতি মুসা রাজা ফার্ডিনান্ডের কাছে আত্মসমর্পণের চেয়ে সম্মুখ সমরে যুদ্ধ করে প্রাণ বিসর্জন দেয়াকেই অধিক সম্মানজনক মনে করে ছিলেন। আবু আব্দুল্লাহ খ্রিষ্টানদের কাছে আত্মসমর্পণ করে প্রাণে রক্ষা পাবেন বলে যে ধারণা করেছিলেন, শিগগিরই তা মিথ্যায় পর্যবসিত হয়। প্রতিশ্রুতি ভঙ্গ করে ফার্ডিনান্ড বাহিনী শহর অবরোধ করে রাখে। বিচ্ছিন্নভাবে যুদ্ধ চালিয়ে যান কিছু মুসলমান। এ সময় রাজা ফার্ডিনান্ডের একটি ঘোষণাপত্র প্রচার করা হয়¬ ‘যেসব মুসলমান নিরস্ত্র হয়ে গ্রানাডার মসজিদগুলোতে আশ্রয় নেবে তাদের পূর্ণ নিরাপত্তা দেয়া হবে। আর যারা খ্রিষ্টান জাহাজগুলোতে আশ্রয় নেবে, তাদের অন্যান্য মুসলিম রাষ্ট্রে পাঠিয়ে দেয়া হবে। অন্যথায় আমাদের হাতে তোমাদের প্রাণ হারাতে হবে।’ অসহায় মুসলমানরা সরল বিশ¡াসে বন্ধ করে দেয় যুদ্ধ। অনেকে আরোহণ করেন জাহাজে, অনেকে আশ্রয় নেন মসজিদে। কিন্তু প্রতারক ফার্ডিনেন্ড মসজিদে আশ্রয় গ্রহণকারী নিরস্ত্র মুসলিম শিশু-বৃদ্ধ, নর-নারীকে পুড়িয়ে এবং জাহাজে আরোহণকারী মুসলমানদের জাহাজ ডুবিয়ে হত্যা করে। এ হৃদয়বিদারক ও করুণ ঘটনা যেদিন ঘটেছিল সে দিন ছিল পয়লা এপ্রিল।
বর্তমানে চালু আছে ‘এপ্রিল ফুল ডে’র নানা রকম ইতিহাস ও গল্প। এপ্রিল ফুল বাংলাদেশের বা প্রাচ্যের কোনো উৎসব বা আনন্দের দিন নয়। বাংলাদেশসহ এই উপমহাদেশে দিনটির প্রচলন হয় ১৭৫৭ সালে পলাশীর আম্রকাননে ইংরেজদের সাথে যুদ্ধে নবাব সিরাজউদ্দৌলার পরাজয়ের পরিণামে। ব্রিটিশরা আমাদের প্রায় ২০০ বছর শাসন করেছিল। অন্য অনেক কিছুর মতো ইংরেজরা এ দেশে তাদের শিক্ষা ও সংস্কৃতির নানা বিষয় চালু করে। এর একটি দৃষ্টান্ত, এপ্রিলের ১ তারিখে ‘এপ্রিল ফুল ডে’ চালু করা।
এপ্রিল ফুল ডে উদযাপনের জন্য একে অন্যকে বোকা বানায়। কেউ কেউ বলে থাকেন, বিভিন্ন দেশে একই সময়ে এপ্রিল ফুল ডে’র সূচনা হয় বিশেষ করে বসন্ত বিদায়ের উৎসবকে সামনে রেখে। ইংল্যান্ডে আঠারো শতক থেকে দিনটি ব্যাপকভাবে উদযাপিত হতে থাকে। ইংরেজ ও ফরাসিরা তাদের উপনিবেশগুলোতে এ প্রথার প্রচলন করে। স্কটল্যান্ডে ৪৮ ঘন্টাব্যাপী এপ্রিল ফুল ডে উদযাপিত হয়। মেক্সিকোতে এ দিবসটি অন্য প্রেক্ষাপটে উদযাপিত হয়ে থাকে। ডিসেম্বরের ২৮ তারিখ খ্রিষ্টানরা এরাডসের হাতে নিষ্পাপ শিশুদের নির্মম হত্যাকাণ্ডের স্মরণে দিনটি উদযাপন করে। ভিন্ন ইতিহাসে ১৫৬৪ সালে ফ্রান্সে প্রবর্তিত নতুন ক্যালেন্ডারকে সামনে রেখে আধুনিক এপ্রিল ফুল ডে উদযাপিত হয়। তার আগে ইউরোপে একটিমাত্র ক্যালেন্ডার ব্যবহৃত হতো। তখন বছরের সূচনা হতো এপ্রিল মাসের ১ তারিখ থেকে। ১৫৬৪ সালে ফ্রান্সের সম্রাট দশম চার্লস এই পুরনো তারিখ পরিবর্তন করেন। তিনি ১ জানুয়ারি থেকে নববর্ষ চালুর ঘোষণা দেন। এটা পৃথিবীর সর্বত্র আজো চালু আছে। ঊনবিংশ শতাব্দীর খ্রিষ্টানদের বিখ্যাত বিশ¡কোষে উল্লেখিত ইহুদি ও খ্রিষ্টানদের বর্ণনায় পয়লা এপ্রিল হলো সেই তারিখ, যাতে পারস্যবাসী ও ইহুদিদের পক্ষ থেকে হজরত ঈসা (আঃ) কে ঠাট্টা-বিদ্রুপের টার্গেট বানানো হয়েছিল। ইঞ্জিলের মধ্যে (বর্তমানে যা বাইবেল) ঘটনার বিবরণ এরূপ্ল ‘আর সে ব্যক্তি ঈসা (আঃ) কে বন্দী করে তার সাথে ঠাট্টা-পরিহাস করত এবং তাকে আঘাত করত, আর চোখ বেঁধে তার গালে চড়-থাপ্পর মারত এবং তাকে এই বলে জিজ্ঞাসা করা হতো, নবুয়তের মাধ্যমে বলো কে তোমাকে মারছে? এভাবে ভর্ৎসনা করে আরো অনেক কথা তার বিরুদ্ধে বলা হয়।’ (লুক, ২২ঃ৬৩-৬৫)। হজরত ঈসা (আঃ) কে বিচারের নামে পিলাতস থেকে হিরোডস আবার হিরোডস থেকে পিলাতসের আদালতে প্রেরণ করার উদ্দেশ্য হলো ঠাট্টা পরিহাস করে তাকে কষ্ট দেয়া। আর এ ঘটনা যেহেতু পয়লা এপ্রিলে সংঘটিত হয়েছিল। সে জন্য এপ্রিল ফুল ডে বাস্তবিকভাবেই একটি লজ্জাজনক ঘটনার স্মৃতি।
কাউকে ধোঁকা দেয়া এবং বোকা বানানো সম্পর্কে ইসলামে রয়েছে কঠোর নিষেধাজ্ঞা। রাসূল সাঃ বলেছেন, ‘ যে ব্যক্তি অন্যকে ধোঁকা দেয়, সে আমার উম্মতের অন্তর্ভুক্ত নয়।’ (মুসলিম, মিশকাত ঃ ২৪৮) ‘অভিশপ্ত ওই ব্যক্তি যে কোনো মুমিন ব্যক্তির ক্ষতি সাধন করে কিংবা তাকে ধোঁকা দেয়।’ (তিরমিজি, মিশকাত ঃ ৪২৮) নবী করিম সাঃ অন্যত্র বলেছেন¬ ‘ যে ব্যক্তি যে জাতির অনুসরণ-অনুকরণ করবে, তার হাশর হবে ওই জাতির সাথে।’ তিনি আরো বলেছেন¬ ‘মুসলিম তো সে-ই, যে কাউকে প্রতারিত করে না, নিজেও প্রতারিত হয় না।’ ইতিহাস পর্যালোচনা করলে প্রতীয়মাণ হয় যে, তারা মুসলমানদিগের শুধু অত্যাচার নির্যাতন কঙ্কালসার এবং কাঙ্গালেই পরিণত করেনি বরং তারা কৌশলে আমাদের জাতীয় ইতিহাস ঐতিহ্যেও আঘাত হানছে দিনের পর দিন। সে কথাও কারো অজানা নয়।
এপ্রিল ফুল উৎসব আজ মুসলমানদের জাতীয় জীবনেও প্রবেশ করেছে। অথচ এর উৎস মূলত মুসলমানদের বিরুদ্ধে স্পেনের মাটিতে খ্রিষ্টানদের প্রতারণাপূর্ণ বিজয়ের ইতিহাস। কেননা, পয়লা এপ্রিলের অন্য সব ইতিহাস ১৪৯২ সালের পরে। আর ঈসা (আঃ) সম্পর্কিত ঘটনার ভিত্তি খুবই দুর্বল। ১৯৯২ সালে পশ্চিমা বিশে¡ স্পেন থেকে মুসলিম উৎখাতের ৫০০তম বার্ষিকী (১৪৯২-১৯৯২) মহা ধুমধামের সাথে উদযাপন করা হয়। ইতিহাসের হৃদয়বিদারক ঘটনা ভুলে না গেলে এপ্রিল ফুল কোনো মুসলমানকে আনন্দ দান করতে পারে না। এখন আমরা কি পয়লা এপ্রিল হাসি-আনন্দের সাথে ‘এপ্রিল ফুল ডে’ উদযাপন করবো, নাকি ইউরোপের বুকে অসহায় মুসলিম নারী-পুরুষ, শিশুদের নৃশংস হত্যাকাণ্ডের স্মরণে দুঃখ অনুভব করব।
যুগে যুগে এপ্রিল ফুল পালনের ইতিকথা
অনেক আগে থেকেই পহেলা এপ্রিল বিভিন্ন দেশে বিভিন্নভাবে উদযাপিত হত। তবে কিভাবে যে এপ্রিল ফুলের সূচনা হয় তা নিয়ে ইতিহাসবিদদের মধ্যে বিস্তর মতভেদ রয়েছে। প্রাচীনকালে জনপ্রিয় উৎসবসমূহ পালিত হত বসন্তকালীন বিষুব সময়ে (Vernal Equinox), অর্থাৎ যে সময়ে দিনরাত মোটামুটি সমান থাকে। সময়টি হল ২১ মার্চ থেকে ২৩ সেপেম্বর পর্যন্ত। ঋতু পরিবর্তনের প্রান্তিক সময় ২৫ মার্চ থেকে ২ এপ্রিল (অর্থাৎ শীতের শেষে বা বসন্তের শুরুতে) পুরাতন জুলিয়ীও (Julian) ক্যালেন্ডার অনুযায়ী গোটা ইউরোপে সপ্তাহব্যাপী উৎসব উদ্দীপনা চলত। এর বাইরে মধ্যযুগে মার্চের ২৫ তারিখে মহাসমারোহে নবান্ন উৎসব পালিত হত সারা ইউরোপ জুড়েও। রোমানদের মত হিন্দুরাও নতুন বছরের শুরু এপ্রিলের ১ অথবা এর আশেপাশে একদিন পঞ্জিকানুযায়ী পালন করত। আঠার শতকে এপ্রিল ফুল বর্তমান অবয়ব ধারণ করার আগ পর্যন্ত গ্রেট বৃটেনে সাধারণ মানুষদের ঐতিহ্যবাহী মেলা বসত প্রতি বছরের পহেলা এপ্রিলে । স্কটল্যান্ডে এই দিনটিকে বলা হত ‘ কোকিল শিকারের দিন (hunting the day of cuckoo)’। এপ্রিল ফুল নতুন রুপে জন্মলাভের পর এর নামকরণ করা হয় এপ্রিল-কোকিল (April-cuckoo)। পূরো কাহিনীর সাথে এই দিনের যোগসূত্র স্থাপন করতে গিয়ে ১৪০০ খ্রিষ্টাব্দের চোসার (Chaucer)-এর The Nuns Priests Tale গল্পের দুই বোকার ৩২ দিনের কাহিনী (Thirty days and two) চলে আসে। আর ৩২ দিনের শুরুটি হল মার্চের ১ তারিখ, অর্থাৎ শেষ দিনটি কিনা ১ এপ্রিল।
ইউরোপে সম্ভবত এপ্রিল ফুলের বিস্তৃতি ঘটে প্রথমে ফ্রেঞ্চ জাতির মধ্যে। ফ্রেঞ্চরা ১৫০৮ সাল এবং ডাচরা ১৫৩৯ সাল থেকে এপ্রিল মাসের প্রথম দিনকে কৌতুকের দিন বা বছরের সবচেয়ে হালকা দিন হিসেবে পালন করা শুরু করে। ফ্রান্সই হলো প্রথম দেশ যেদেশে সরকারীভাবে নবম চার্লস (Charles IX) ১৫৬৪ সালে এক ফরমানের মাধ্যমে ১ জানুয়ারীকে নববর্ষ হিসেবে ঘোষণা করেছিলেন।
অর্থাৎ তিনি এটি করেন ১৫৮২ সালে ইতালিয়ান পোপ ত্রয়োদশ গ্রেগরী (Pope Gregory XII) প্রবর্তিত গ্রেগরীয়ান ক্যালেন্ডার (যেটিকে আমরা বর্তমানে ভুল করে ইংলিশ ক্যালেন্ডার বলি) হিসেবে প্রচলন হওয়ারও আগে। এরই সাথে ১ এপ্রিলে বন্ধু-বান্ধবদের উপহার দেয়া-নেয়ার প্রথাটি বদল হয়ে চলে যায় ১ জানুয়ারী বা নিউ ইয়ার উদযাপনের প্রাক্কালে। কারণ তখন পর্যন্ত বিভিন্ন দেশে জুলিয়ীও ক্যালেন্ডার অনুযায়ী নিউইয়ার পালিত হত ১ এপ্রিলে। অনেকেই এই পরিবর্তনকে মেনে নিতে না পেরে এদিনই অর্থাৎ ১ এপ্রিলেই তাদের পুরোনো প্রথাসমূহ চালিয়ে যেতে থাকে। কিন্তু বিপরীতে ১ জানুয়ারীর পক্ষের লোকজন এদেরকে ফাকি দিতে ১ এপ্রিলে ভূয়া উপহার পাঠানোর কালচারটি চালু করে দেয়। ফ্রান্সে কাউকে বোকা বানালে বলা হত এপ্রিল মাছ (April fish), ফ্রেঞ্চ ভাষায় poisson davril । এরকম অদ্ভূত নামকরনের ব্যাখায় বলা হয়, রাশিচক্র অনুযায়ী স¡র্গের কালিকরেখা অতিক্রম করাকালে এপ্রিলে সূর্যকে মাছের মত দেখায়। এইদিনে তারা ছুটি কাটাত এবং মরা মাছ এনে তাদের বন্ধুদের পেছনে সেটে দিয়ে মজা করত। এখন মরা মাছের বদলে ছোটরা আসল মাছের স্টিকি কাগজ বন্ধুদের শার্টের পেছনে গেঁথে দেয়। ক্যান্ডিশপ ও বেকারীগুলোও মাছ আকৃতির মিষ্টি পরিবেশন করে এইদিন স্মরণ করে।
ডাচদের পহেলা এপ্রিল পালন করার আরো কিছু কারণ আছে। স্পেনের রাজা দ্বিতীয় ফিলিপ (King Philip II) ১৫৭২ সালে নেদারল্যান্ড শাসন করতেন। যারা তার শাসন অমান্য করেছিল তারা নিজেদেরকে গুইযেন (যার অর্থ ভিখারী) বলে পরিচয় দিত । ১৫৭২ সালের এপ্রিলের ১ তারিখে গুইযেন বা বিদ্রোহীরা উপকূলীয় ছোট শহর ডেন ব্রিয়েল (Den Briel) করায়ত্ব করে ফেলে। তাদের এই সফলতায় বিদ্রোহের দাবানল দেশব্যাপী ছড়িয়ে পড়ে। শেষমেশ স্প্যানিশ সেনাপ্রধান বা দ্য ডিউক অব অ্যালবা (the Duke of Alba) প্রতিরোধ করতে ব্যর্থ হন। ‘ব্রিয়েল’ হল ডাচ শব্দ, যার অর্থ কাঁচ। ১৯৭২ সালের ১ এপ্রিল স্মরণে ডাচরা বিদ্রুপ করে স্প্যানিশদের ‘অ্যালবা কাঁচ হারিয়েছে (Alba lost glasses)’ বলে পূরোনো স্মৃতি রোমন্থন করে থাকে। উল্লেখ্য, অ্যালবা হল স্পেনের শহরের নাম যেখানে দ্য ডিউক অব অ্যালবার সদর দপ্তর ছিল।
এপ্রিল ফুলের আরেকটি ব্যাখ্যা দিয়েছেন বোস্টন বিশ¡বিদ্যালয়ের ইতিহাসের প্রফেসর জোসেফ বসকিন (Joseph Boskin)। তিনি বলেছেন এই প্রথাটির শুরু হয় রোমান সম্রাট কনস্ট্যান্টাইনের (২৮৮-৩৩৭ খ্রীঃ) শাসনামলে। হাসি-ঠাট্টা নিয়ে মেতে থাকে এমন একদল বোকা গোপাল ভাঁড়েরা সম্রাটকে কৌতুক করে বলে, তারা রাজার চেয়ে ভালভাবে দেশ চালাতে পারবে। রাজা মহোদয় বেশ পুলকিত হলেন। রাজা গোপাল ভাড়দের সর্দার কুগেল (Kugel) কে একদিনের জন্য বাদশাহ বানিয়ে ক্ষমতা ছেড়ে দিলেন। আর কুগেল সুযোগটাকে কাজে লাগিয়ে রাজ্যময় আইন জারি করে দিল, প্রতিবছরের এইদিনে সবাই মিলে তামাশা করবে। প্রফেসর বসকিন আরো বলেন, প্রাচীন ওই সময়ের মারাত্মক দিনগুলোতে রাজাদের দরবারে কিন্তু বোকারুপিরাই ছিল প্রকৃত জ্ঞানী। তারা মজা বা হাসি-ঠাট্টার মাধ্যমে অনেক কাজ কৌশলে হাসিল করে নিত বা জ্ঞানের কথা রসালোভাবে চারদিকে ছড়িয়ে দিত।
১৯৮৩ সালে বার্তা সংস্থা এপি পরিবেশিত বসকিনের এই ব্যাখ্যাটি অনেক কাগজে নিবন্ধাকারে প্রকাশিত হয়। বসকিন মূলত- আগের সব ব্যাখ্যাকে উড়িয়ে দিয়েছেন। আর্টিকেলটি ছাপানোর আগে এপি দুই সপ্তাহ ধরে ভেবেছে তারা নিজেরাই এপ্রিল ফুল বোকামীর শিকার হচ্ছে না তো! পাশ্চাত্যের বিভিন্ন সংস্কৃতিতে কাউকে বিভিন্নভাবে বোকা বানানোর প্রথা চালু রয়েছে। রোমানদের হিলারিয়া (Hilaria) উৎসব এর মধ্যে অন্যতম। তারা মার্চের ২৫ তারিখে আট্টিসের পূনরুত্থান নিয়ে এইদিনে হালকামি করত, ইহুদীরা করত পুরিম (Purim) উপলক্ষ্যে। হিন্দুরাও হোলি উৎসব এইদিনের আশেপাশে করে থাকে। ইসলামে মিথ্যা কথা বলে ঠকানো কঠোরভাবে নিষিদ্ধ। যেমন, নবী (সঃ) বলেছেন, “যারা ধোঁকাবাজি করে তারা আমাদের দলভুক্ত নয়।” তবে ইসলামে সত্য কথা বলেও হাস্যরস করা বা বিভিন্ন রকমের জ্ঞানোদ্দীপক কৌতুকের প্রচলন রয়েছে। মুহম্মদ (সাঃ) এবং তার সংগীসহ ইসলামী ব্যক্তিত্বের অনেকের জীবনীতেই প্রচুর রসালো গল্পের উদাহরণ ইতিহাসে পাওয়া যায়।
অন্যান্য দিবসের মত এই দিবসটিরও উৎপত্তি পাশ্চাত্যে শুরু হলেও এর বিস্তৃতি এখন দেশে দেশে। শুধুমাত্র বাংলাদেশে (বৃহৎ অর্থে, উপমহাদেশে) কিছু মুসলমানদের মধ্যে এপ্রিল ফুলের ব্যাখ্যায় নতুন মাত্রা লাভ করেছে। তা হলো, গ্রানাডার বেদনাদায়ক ঘটনার সংযোজন। সুদীর্ঘ আটশো বছরের ইসলামের গৌরবময় শাসন শেষে স্পেন মুসলমানদের হাতছাড়া হয় ১৪৯২ সালে। বলা হয়, পরাজিত হাজার হাজার মুসলমান নারী, পুরুষ, শিশুদেরকে মসজিদের মধ্যে কৌশলে ঢুকিয়ে রাজা ফার্দিনান্দ ও পর্তুগিজ রানী ইসাবেলার নির্দেশে পুড়িয়ে মেরে জঘন্যতম এই কাণ্ডটি করা হয় ইতিহাসের এই দিনে। ইতিহাসবিদরাই ভাল বলতে পারবেন কোনটি সঠিক। গ্রানাডার সর্বশেষ মূরিশ কিং হলেন নাসরিদ বংশীয় আবু আব্দুল্লাহ মোহাম্মদ (Abu Abdullah Muhammad XII), যাকে স্প্যানিশরা ‘ বোয়াবদিল’ নাম দিয়েছে। বিলাস-ব্যসনে মত্ত ও উচ্ছন্নে যাওয়া আবু আব্দুল্লাহ হলেন গ্রানাডার তাইফার সুলতান আবুল হাসানের ছেলে। ছেলের ষড়যন্ত্র ও কুচক্রের কারণেই অনেকটা সিরাজউদ্দৌলার মতই বাবা আবুল হাসান পালিয়ে যেতে বাধ্য হন। মীরজাফরের মত আবু আব্দুল্লাহকে বানানো হয় নামকাওয়াস্তে সুলতান। এই পুতুল সুলতানের কাছেও ১৪৮৯ সালে ফার্দিনান্দ ও ইসাবেলার নিকট থেকে চুড়ান্তরুপে নিঃশর্তভাবে আত্মসমর্পনের নির্দেশনা আসে এবং স্মরণ করিয়ে দেয়া হয় অস¡ীকারের ভয়াবহ পরিনতির কথাও। সে সময়ে এপ্রিল ফুলের ঘটনার মত কোন ঘটনা ঘটেছে কিনা ইঊরোপীয় ঐতিহাসিকরা তা উল্লেখ করেননি।
আত্মসমর্পন ঘটনার তিনমাস পরে স্পেনের বিপর্যস্ত মুসলমানদেরকে মসজিদের মধ্যে ঢুকিয়ে পুড়িয়ে মারা হয়েছে, নাকি ইতিহাসের অলীক মারপ্যাচে বাংলাদেশের মুসলমানদেরকেই এপ্রিল ফুলের বোকা বানানো হয়েছে তা নির্নয়ের দায়িত্ব ইতিহাসবেত্তাদের নিকটই ছেড়ে দিলাম।
Comments
Post a Comment